কবিতার প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি


কবিতা! হজরত আবদুল্লাহ ইবন আমর রা. বলেন, ♦নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'কবিতা তো কথারই মতো। রুচিসম্মত কবিতা উত্তম কথাতুল্য, কুরুচিপূর্ণ কবিতা কুরুচিপূর্ণ কথাতুল্য।’ (মুসলিম)

কবিতার উত্তম সংজ্ঞাটা দিয়েছেন মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ)। কিছু কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী কবিতাকে ইসলামে নাজায়েজ বলে মনে করে থাকেন। অথচ, নবী (সঃ) সহ সাহাবায়ে কেরামের প্রত্যেকেই ছিলেন আরবি ভাষায় পারদর্শী ও সাহিত্যমনস্ক। কবিতার ক্ষেত্রে রাসূলের সাহাবিখ্যাত ‘ত্রয়ী’ হজরত হাসসান ইবনে সাবিত, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা ও কাব ইবনে মালিক রা.-এর পারঙ্গমতা সাহিত্য মহলে সুবিদিত।
প্রধান চার খলিফার তিনজনই সাহিত্যালয়ে ঝলমলে। ইতিহাসের বিভিন্ন বর্ণনানুযায়ী তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কবিতা রয়েছে।
তৎকালীন আরব ছিলো সাহিত্য-চর্চার প্রাণকেন্দ্র। যিনি সেরা কবিতা উপহার দিতে পারতেন তিনিই সবার কাছে সেরা হিসেবে সমাদৃত হতেন।

ইসলাম কখনো কবিতাকে হারাম বলে আখ্যায়িত করেনি। বরঞ্চ, কবিতার ব্যবহারের মাধ্যমে ইসলামের মাহাত্ম্যকে প্রচার করেছে। তবে হ্যা, কবিতা যখন নগ্নতা ছড়ায়, কবিতা যখন একাত্মবোধকে নষ্ট করে তখনই তা উপড়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। কবিতা তখনই সুন্দর যখন কবিতার মাধ্যমে ধর্ম, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, সভ্যতাকে প্রকাশ করা হয় পবিত্র ও উন্নত শব্দগুলোকে ব্যবহার করে। আসুন তবে দেখে নিই কবিতা সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা!😊

♦হজরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি বা এক বেদুইন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও আকর্ষণীয় ভাষায় কথাবার্তা বললো। তখন নবীজী বললেন, কথায়ও যাদুকরী প্রভাব থাকে এবং কবিতাও প্রজ্ঞাপূর্ণ হতে পারে। (তিরমিযি ও আবু দাউদ)

♦হাদিসের একটি ঘটনা শুনুন! হজরত শারিদ ইবনে সালামি রা. বলেন আমি একদিন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সফরে ছিলাম।
নবীজী আমাকে বলেন, তোমার কাছে কী কবি উমাইয়া ইবনে আবিস সালত এর কোনো কবিতা আছে? আমি বললাম, জি। তিনি বললেন, শোনাও আমাকে! তারপর আমি কিছু কবিতা শোনালাম। তিনি বলেন, আরো শোনাও!

আমি আরো কিছু কবিতা শোনালাম। তিনি বলেন, আরো শোনাও। এভাবে আমি তাকে উমাইয়া ইবনে আবিস সালতের প্রায় ১০০টি কবিতা শোনালাম।
পাঠক সুহৃদ! উমাইয়া ইবনে আবিস সালত কে, জানেন? তিনি হলেন জাহেলি যুগের একজন কবি। কিন্তু তার কবিতায় উত্তম কথামালা থাকায় এবং অশ্লীল বেহায়াপনা ও ঈমান বিনষ্ট কোনো উপাদান না থাকায় স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কবিতা বেশ সময় নিয়ে শুনেছেন এবং হজরত শারিদ ইবনে সালাম রা. উমাইয়া ইবনে আবিসের কবিতা মুখস্থ রাখার কারণে কোন বকাঝকাও করেননি।

আবার কবিতায় নাজায়েজ থাকলেও সে ব্যাপারে সতর্ক করেছে ইসলাম। এরকম একটি হাদিস-

♦হজরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোন ব্যক্তি কবিতা দিয়ে পেট ভর্তি করার চেয়ে পুঁজ দিয়ে পেট ভর্তি করা অনেক উত্তম।’

♦এরকম আরেকটি হাদিস শুনি। যে হাদিসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবিতাকে খারাপ বলেছেন।
‘আম্মাজান হজরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মানুষের মধ্যে মারাত্মক অপরাধী হলো সেই কবি, যে সমগ্র গোত্রের নিন্দা করে এবং যে ব্যক্তি নিজ পিতাকে অস্বীকার করে।’ (মুসলিম ও মুসনাদ আহমদ)

পবিত্র কোরআনে কবিদের সম্মন্ধে সূরা আশ-শুয়ারায় মহান আল্লাহ বলেন_
‘কবিদের যারা অনুসরণ করে তারা বিভ্রান্ত। আপনি কি দেখেন না যে, তারা মাঠে ময়দানে উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন কথা বলে যা তারা করে না। তবে তাদের কথা ভিন্ন যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে এবং অত্যাচারিত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। অত্যাচারীরা অচিরেই জানবে কোন স্থানে তারা ফিরে আসবে। (সূরা আশশুয়ারা, আয়াত ২২৪-২২৭)

এই আয়াত নাজিল হওয়ার পর কবি ও কবিতাপ্রেমী হজরত আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা, হজরত হাসসান বিন সাবিত, হজরত কাব ইবনে মালিকসহ প্রমুখ সাহাবী কাঁদতে কাঁদতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হয়ে আরজ করেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ তায়ালা কেন এই আয়াত নাজিল করেছেন?
আমরাও তো কবিতা রচনা করি, এখন আমাদের উপায় কী হবে? তাহলে কী আমরা কবিতাচর্চা বন্ধ করে দেব?

♦নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আয়াতের শেষাংশ পাঠ করো। এই আয়াত নাজিলের উদ্দেশ্য হলো, তোমাদের কবিতা যেন অনর্থক ও ভ্রান্তির উদ্দেশ্যে রচিত না হয়। এই আয়াতের প্রথমাংশে মুশরিক, মুনাফিক কবিদের সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং শেষাংশে তৎকালীন সমাজে ব্যতিক্রমী কবিদের কথা বলা হয়েছে। কাজেই তোমরা আয়াতের শেষাংশে উল্লিখিত কবিদের শামিল।’ (ফতহুল বারী)

এসব হাদিস ও কোরআনের আয়াতগুলো দ্বারা আমরা বুঝলাম_কবিতার মধ্যে মন্দ বিষয় থাকায় কবিতাকে খারাপ বলা হয়েছে। আর কবিতার মধ্যে ভালো বিষয় থাকলে ভালো বলা হয়েছে।

মূলত কবিতার আছে যাদুকরি প্রভাব। একারণেই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবিতা শুনতেন, কবিতা পছন্দ করতেন, কবিদের ভালবাসতেন।

সস্তা ভাব, চটুল ভাষা আর মিথ্যা উপমায় যেন ভারাক্রান্ত না হয় আমাদের কবিতা। হজরত ওমর ফারুক, হজরত আলী ইবনে আবু তালিব, হজরত হাসসান বিন সাবিত, হজরত কা’ব বিন মালিক, হজরত কা’ব বিন যুহায়র, হজরত আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা রা. ও ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফিয়ী, ইমাম বুসিরী, শেখ সাদী, জালালুদ্দিন রুমী, জামী, ফরিদুদ্দিন আত্তার, ইবনুল আরাবি, ওমর খৈয়াম, মির্জা গালিব, আল্লামা ইকবাল, আলতাফ হালী, নজরুল, ফররুখের মত আমাদের কবিতা যেন হয় অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের হাতিয়ার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের অজেয় দুর্গ!
মুসলিম উম্মাহর এ দুর্দিনে কবিতা হোক মুক্তির হাতিয়ার।

আসুন আমরা কবিতায় নগ্নতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে উত্তম কথাগুলোকে জীবন্ত করে তুলি। আমাদের কবিতায় প্রকাশ হোক চরম সত্য পথ, রাষ্ট্র, জীবন্ত দ্বীন, সুন্দরতম সংস্কৃতি।

ভালবাসা সকল কবি ও কবিতার জন্য! ❤️

মন্তব্যসমূহ